Last updated on November 18th, 2021 at 06:59 pm
আশা করি সবাই ভালা আছেন। আজ আমি লিখছি আমার ইন্ডিয়া ভ্রমনের দ্বিতীয় পর্ব। আগের পর্বে লিখেছি এই ভ্রমনের কলকাতা থেকে মানালি পর্যন্ত ভ্রমণের গল্প। আজ থাকবে বাকি অংশ। আগের পর্ব এখনো পড়ে না থাকলে পড়ে নিন।
এই ট্যুরের গল্পটি আমি তিন পর্বে লিখছি। প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব থাকছে ভ্রমণ কাহিনী আর শেষ পর্বটি হবে গাইডধর্মী যেখানে কিছু টিপসসহ সম্পূর্ণ ট্যুরের খরচের প্ল্যান দেওয়া থাকবে।তো শুরু করা যাক!
⭐২য় পর্ব⭐
ছবিগুলো বড় করে দেখতে ছবির উপর ক্লিক/ট্যাপ করুন।
Table of Contents
সপ্তম দিন (২৪জুন) – রোথাং পাস ভ্রমণ
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গতদিন গাড়ি রিজার্ভ করে রাখা হয়েছিলো। সেটাতে চড়ে বসলাম। খানিক বাদেই গাড়িটি আবার পাহাড় চড়তে লাগলো। যত সময় গেল শুধু উপরে উঠতেই থাকলাম। পথে এক জায়গা থেকে বরফে চলার জন্য কাপড় ভাড়া করে নিলাম। একসময় পৌঁছুলাম সোলাং ভ্যালিতে। জুন-জুলাই মাস ছাড়া বছরের অনান্য সময় এতো বরফ পড়ে যে রোথাং পাসের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন সোলাং ভ্যালিতেই বরফ পাওয়া যায়। সেখানে তেমন কিছু দেখলাম না।
আবার গাড়িতে চড়ে চলতে শুরু করলাম। মাত্র দেড় মাস খোলা থাকে বলে রোথাং পাসের রাস্তায় প্রচণ্ড ভীড়। পুরো ভারত থেকেই প্রচুর মানুষ এসেছে। সাদা চামড়ার দুয়েকজন বিদেশীও দেখলাম। এরকম পাহাড়ি রাস্তাতেও দেখলাম প্রচুর মানুষ বাইকে করে যাচ্ছে। এমনকি দুই-তিনজন সাইক্লিস্টসও দেখলাম। রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। হাজার হাজার গাড়ির সিরিয়াল রোথাং পাসের রাস্তায়।
গতদিন দূর পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা যে বরফ দেখেছিলাম আজ তার কাছাকাছি চলে এসেছি। ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছি। এখন বেশ কাছ থেকেই বরফ দেখতে পাচ্ছি। দূরে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে মানালি শহর!
অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফিট উচ্চতায় রোথাং পাসে পৌঁছুলাম। চারিদিকে বরফ আর বরফ। হাত দিয়ে একদলা বরফ ছুঁয়ে দেখলাম। বেশ ভাল লাগছিলো। অনেক মানুষ এসেছে এখানে। আমরা বরফে স্লাইডিং করলাম। স্নো বল বানিয়ে একে অপরকে ছুড়ে মারলাম।
এর মধ্যে ঠিক মাথার উপরেই মেঘ ঘনিয়ে আসলো। শুরু হলো বৃষ্টি। ঠাণ্ডায় কাঁপন ধরে গিয়েছিলো। পরে গাড়িতে চলে আসলাম। বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। পুরোটা জায়গা মেঘে আচ্ছাদন করে রাখায় আশেপাশে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিলো না। গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে খুব সতর্কতার সাথে চলছিলো।
রোথাং পাস আসার পথে আমরা পাহাড়ের এক রূপ দেখেছিলাম। এখন আবার ফেরার পথে আরেক রূপ দেখতে পেলাম। মাঝে গাড়ি ব্রেক দিলো। নেমে চা নাস্তা করলাম। আর চোখের সামনে অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য দেখলাম। চোখের সামনে মেঘ জমতে দেখলাম। যে দৃশ্যটা খুবই সুন্দর ছিলো।
এভাবে চলতে চলতে মানালি পৌঁছলাম। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। রুমে খাবার নিয়ে এসে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
অষ্টম দিন (২৫ জুন) – দিল্লী যাত্রা
আমি ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় এগারোটায়। বাইরে বৃষ্টির মধ্যেই সকালটুকু যে যার মতো ঘুরলো। আমি কম্বল পেঁচিয়ে আরাম করে শুয়ে শুয়ে ভারতের চ্যানেলগুলো দেখতে লাগলাম। গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। দুপুরবেলা বের হয়ে খাওদাওয়া করে মল রোডের পাশেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে উঠলাম। তিনটা বিশে দিল্লীর উদ্দেশ্যে বাস ছাড়লো। একটু ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় ঔষধ খেয়েছিলাম যার ফলে বাসের সিটে হেলান দিয়ে মরার মত ঘুমালাম। মাঝে একটু সময় হুশ ফিরে আসলে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মানালি থেকে কুল্লু-মান্ডির রাস্তায় আমরা। বিয়াস নদীর তীর ঘেঁষে দুই পাহাড়ের মাঝের গিরিখাতে বাস ছুটে চলেছে। যত নামতে লাগলাম ততই নদীর প্রশস্ততা আর স্রোত বাড়তে থাকলো। মাঝখানে একটা পাহাড়ের ভেতর টানেল পার হলাম। আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো রাতের বেলা বাস একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য ব্রেক দেওয়ায়। আবহাওয়া ঠাণ্ডা থেকে আবার অনেকটাই গরম হয়ে গিয়েছে। খাবারের দাম না জানি কেমন হয় এই ভয়ে ভয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি মাত্র ৭০রুপিতে ব্যুফে দিচ্ছে যাতে আছে আনলিমিটেড রুটি, সবজি, ভাত ইত্যাদি!
নবম দিন (২৬ জুন ) – দিল্লী ভ্রমন
ভোরবেলা পৌঁছুলাম দিল্লীতে। আগে গেলাম নয়াদিল্লী রেল স্টেশনে কলকাতার টিকিট কাটতে। আগ্রা-কলকাতা টিকিট কেটে চলে আসলাম জামে মসজিদ এলাকায়। হোটেল খুঁজে একটা রুম নিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নিলাম। দুপুরে জামে মসজিদে নামাজ পড়লাম। জামে মসজিদ স্থাপনাটি প্রাচীন ও সুন্দর।
সেখান থেকে হেঁটে গেলাম রেড ফোর্ট তথা লাল কেল্লায়। দিল্লীতে তখন ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। স্বর্গের মতো বরফ এলাকা ছেড়ে যেন দোযখে এসে পড়েছি। রোদে ঝলসে কাবাব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এর মধ্যেই লাল কেল্লায় ঢুকলাম। বিশাল এক দুর্গ এই লাল কেল্লা। ভিতরেও অনেক বড় বড় স্থাপনা আছে।
সেখান থেকে বেরিয়ে উবারে করে গেলাম ইন্ডিয়া গেট। ভারতের স্মৃতিসৌধ বলা চলে এটাকে। সন্ধ্যা নামতে ইন্ডিয়া গেটের লাইটিং একে আরো মনোমুগ্ধকর করে ফেলল।
দিল্লীর রাস্তাঘাট ঘুরে আমরা আবার জামে মসজিদ এলাকায় ফিরে আসলাম। এখানে কেজি দরে বিরিয়ানি বিক্রি করে। ৭০রুপিতে হাফ কেজি খাসির বিরিয়ানী দিয়ে খাওয়া সেরে রুমে চলে আসলাম।
দশম দিন (২৭ জুন ) – তাজমহল ভ্রমন
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্টেশনে চলে আসলাম। গন্তব্য ২০০কিমি দূরের আগ্রা।
প্রায় তিন ঘন্টা পরে আগ্রা পৌঁছুলাম। স্টেশন থেকে সোজা চলে গেলাম তাজমহলে। আগ্রাতে গরম আরো বেশি। তাপমাত্রা ৪৩ডিগ্রি ছিলো তখন। চোখের সামনে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য তাজমহল দেখে বেশ ভাল লাগছিলো।
ছবিটবি তুলে ঘোরা ফেরা করে চলে আসলাম আগ্রা ফোর্টে। অনেকটা লাল কেল্লার মতোই এই আগ্রা ফোর্ট। আগেকালে রাজারা এমন সব দুর্গে থাকতো ভাবতেই মন আনমনা হয়ে যায়। স্থাপনাগুলোও বিশাল বিশাল। আর দুর্গের বাইরে শত্রুর মোকাবিলার জন্য বড় পাঁচিল করা আর তার সামনে পরিখা।
ঘোরা শেষ হলে আবার স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। ট্রেন আসলে চড়ে বসলাম ট্রেনে। প্রায় ২৪ ঘন্টার জার্নি আগ্রা টু কলকাতা। এটাও ছিলো স্লিপার কোচ। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
একাদশতম দিন (২৮জুন ) – ট্রেন জার্নি
সারাদিন ঝিকঝিক করে ট্রেন চললো। প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিলো। ট্রেন থেকে বাইরে তাকালেও তেমন একটা সবুজের দেখা মিলছিলো না। অনেকটা মরুভূমির টাইপের। একে তো গরম আবার এত লং ট্যুর হওয়ায় সবাই কেমন জানি ঝিমিয়ে পড়ছিলো। ট্রেনের জানালার ধারে বসে বসে কেমন দেশের কথা ভেবে একটু বিষণ্ণ লাগছিল। অবাক লাগছিলো একদম সবজায়গায় চার লেনের রাস্তা করে রেখেছে সরকার কিন্তু মাঝেসাঝে দুয়েকটা বড় ট্রাক ছাড়া কোন গাড়ি চোখে পড়ছিলো না। আর রেললাইনের জন্য কোন রাস্তায় ক্রসিং নাই। সবখানে ওভারপাস অথবা নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করে দেওয়া; একদম অজপাড়াগাঁয়েও।
বিকেলবেলা গরমটাও কমে এল আর আমরা পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করলাম। রাতে কলকাতার দমদমে নেমে মেট্রোতে করে চলে আসলাম আবার সেই নিউমার্কেটে। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিলো। আবার সেই কালাভূনা দিয়ে তৃপ্তি করে খেয়ে হোটেলে আসলাম। ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে দশটার দিকে বের হলাম। ঘুরলাম রাতের কলকাতা। ডোমিনোজ পিজ্জা চোখে পড়ায় টেস্ট করলাম। তারপর হোটেলে চলে আসলাম আবার।
দ্বাদশ দিন/শেষ দিন (২৯জুন) – দেশে ফেরা
আজ দেশে ফেরার পালা। দীর্ঘ বারো দিনের পর দেশে ফিরছি ভাবতেই ভালো লাগছিলো। আবার ট্যুর শেষ ভেবে খারাপও লাগছিলো। সকালবেলাটা আমরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা করেই কাটিয়ে দিলাম। ট্যাক্সিতে করে শিয়ালদহ এসে বনগাঁর মেইল ট্রেনের টিকিট কেটে চড়ে বসলাম। দুই ঘন্টার কিছু কম সময় লাগলো আসতে। বৃষ্টি পড়ায় গরম থেকে স্বস্তি মিলছিলো। বনগাঁ থেকে পেট্রাপোল বর্ডারে এসে অল্প যা রুপি ছিলো সব খরচ করে ফেললাম। তারপর বর্ডার ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম খুব সহজে মাত্র পনের মিনিটের মধ্যেই। বেনাপোল ঢুকে আগে বাংলার ভাত আলুভর্তা ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে দেশি স্বাদে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এই খাবারই অমৃত মনে হচ্ছিলো। তারপর বাসে চড়ে ফরিদপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বাজলো। আর শেষ হলো বারো দিনের ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া ট্যুরের!
পরের পর্ব (খরচের হিসাব)
আশা করি ভাল লেগেছে আমার ভ্রমণ কাহিনী। খরচের হিসাব হবে আগামী পর্বে।
কোন প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় করতে পারেন। আমি যথাসাধ্য উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বি. দ্র. দেশে হোক দেশের বাইরে হোক নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত কেউ কোন আবর্জনা ফেলবেন না। পরিবেশ ঠিক রাখুন আর ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করুন!
ইন্ডিয়া ভ্রমন সংক্রান্ত অন্যান্য পোস্ট
নোটিশঃ সম্পুর্ন লেখা কপি করা নিষেধ। কোথাও কোন বিশেষ অংশ সাহায্যের জন্য দিতে পারেন তবে অবশ্যই ক্রেডিট হিসেবে এই পোস্টের লিংক দিবেন। অনেক সময় দিয়ে আপনাদের সুবিধার্ধে এই লেখাটি লিখা হয়েছে, তাই আশা করব কপি পেস্ট থেকে বিরত থেকে লেখকের কষ্টের মূল্য দিবেন। 🙂